মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন
মাওলানা আবদুল জাব্বার:
‘আমি কি তোমার অন্তর প্রশস্ত-প্রশান্ত করে দেইনি? তোমার ওপর থেকে ভীষণ বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যা তোমার পিঠ ভেঙে দিচ্ছিল? তোমার মান-সম্মান উঁচু করেছি? তাহলে অবশ্যই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি রয়েছে। অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে স্বস্তি। তাই যখনই কোনো কাজ থেকে অবসর পাও, তখনই নিবেদিত হও, তোমার প্রভুকে পাওয়ার জন্য তার দিকে ফিরে যাও।’ সুরা আল ইনশিরাহ
জীবন মানেই নানাবিধ সমস্যা, হাজারো ঝড়-ঝাপটা। এমন সমস্যা ও প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধারণ করে প্রতিদিন হাসিমুখে দায়িত্ব পালন, নিজের কাজটি ঠিকঠাক আদায়ের চেষ্টা করে যাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। এত যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য প্রশস্ত অন্তর দরকার। অন্তরের প্রশস্ততা না থাকলে, অল্পতেই মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়। মানুষের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়। দিনের পর দিন এত অন্যায়-অবিচার সহ্য করতে না পেরে বুক ভেঙে যায়। তারপর একসময় ইসলামের পথ থেকে তারা ঝরতে থাকে। এ কারণে যাদের অন্তরকে আল্লাহতায়ালা প্রশস্ত করে দেন, শুধু তারাই পারে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামের পথে অবিচল থাকতে। ‘কাজেই যাকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখানোর ইচ্ছা করেন, তার অন্তরকে তিনি ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন।’ সুরা আল আনআম : ১২৫
অন্তরের প্রশস্ততা না থাকলে ইসলামের নিয়ম-কানুন মেনে চলা সবসময় সম্ভব হয় না। তখন মানুষ ইসলাম নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহে ভোগে। ‘সুদ আর ব্যবসায় লাভ তো একই কথা। কেন ইসলামে সুদ হারাম?’ ‘দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে কেন? তিন ওয়াক্ত হলে কী সমস্যা হতো?’ ‘মাত্র আড়াই শতাংশ সম্পদ জাকাত দিয়ে কী লাভ হবে?’ ‘উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কেন ছেলেদের মেয়েদের দ্বিগুণ সম্পত্তি দেওয়া হয়, এটা কি অন্যায় নয়?’ ‘কেন মেয়েদের হিজাবের মতো একটি কঠিন কাজ করতে হবে?’ এমন অজস্র প্রশ্ন-আপত্তি আর নানা সমস্যায় মানুষ ভোগে। ইসলাম তার কাছে অনেকটা তিক্ত বিষয়ে পরিণত হয়। চোখ-মুখ কুঁচকে সে কোনোভাবে ইসলাম মেনে চলে। কিন্তু সেই মানায় নেই কোনো শান্তি, তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতা।
কিন্তু যখন অন্তরের প্রশস্ততা চলে আসে, তখন আল্লাহর নির্দেশ মানতে আর কোনো সমস্যা থাকে না। সে বুঝে যায়, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সে এক মামুলি মানুষ মাত্র। এভাবে মানুষ যখন নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারে, প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নিজেকে সংযত করতে পারে, নিজের অহংকারকে দমাতে পারে, তখন সে দয়াময় আল্লাহর প্রতি পরম ভরসায় তার সব আদেশ-নিষেধ ও বিধান খুশি মেনে চলে। ইসলাম মেনে তখন সে শান্তি এবং তৃপ্তি খুঁজে পায়। আল্লাহতায়ালা তাকে ইসলাম বোঝার সামর্থ্য দিয়েছেন, এ জন্য সে কৃতজ্ঞতায় বিনত হয়। তখন তার প্রতিটি সেজদা হয় কৃতজ্ঞতায় ভরা, বিনম্রতা মেশানো শ্রদ্ধার সেজদা। ‘যার অন্তরকে আল্লাহ প্রশস্ত করে দেন ইসলামের প্রতি এবং যে তার রবের পক্ষ থেকে আসা এক আলোর মধ্যে রয়েছে, সে কী আর তার মতো হবে, যে কি না এগুলো পায়নি?’ সুরা আয জুমার : ২২
হজরত মুসা (আ.)-এর সেই বিখ্যাত দোয়া আমরা নিয়মিত পড়ি। ‘ও আমার প্রভু, আমার অন্তরকে প্রশস্ত-প্রশান্ত করে দিন। আমার কাজগুলো সহজ করে দিন।’ সুরা ত্বহা : ২৫-২৬
‘তাহলে অবশ্যই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি রয়েছে। অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে স্বস্তি’ কোরআনে করিমের এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়তা দিয়েছেন, প্রতিটি কষ্টের সঙ্গে জীবনের অন্য কোনো না কোনো দিকে কমপক্ষে দুটো স্বস্তি আসবেই। দেখবেন জীবনে একটি কষ্ট এসেছে, কিন্তু অন্য দুটো দিকে ভালো কিছু না কিছু হয়েছে। মাআরিফুল কোরআন যাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থা আছে, তারা বিপদের মধ্যে ডুবে থেকেও দেখতে পান, আল্লাহ তাকে কতভাবে সাহায্য করছেন সেই বিপদ অতিক্রমের জন্য। কিন্তু যাদের ইমান নড়বড়ে, আল্লাহর ওপর আস্থা নেই, তারা বিপদে পড়ে চারদিকে অন্ধকার দেখতে থাকেন। হতাশ হয়ে যান। ভরসা হারিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। যতটা না কষ্ট এসেছে, তার থেকে বেশি কষ্ট, অশান্তি নিজেরাই সৃষ্টি করে নিই। শরীরের দাবির দিকে খেয়াল না রেখে অসুস্থ হয়ে যাই। তারপর চরম অবসাদ, হতাশায় ডুবে যাই। এগুলো সবই নিজেদের তৈরি সমস্যা। এক সময় দেখা যায়, বড় কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু আমাদের অস্থিরতা, কৃতজ্ঞতা এবং ভুলের কারণে সেই সমস্যা ডালপালা গজিয়ে বিশাল জটিল আকার ধারণ করেছে। মানুষের জীবনটা যে কষ্ট এবং স্বস্তির একটি চক্র, সেটা এই আয়াত দুটিতে দেখানো হয়েছে। কোনো কষ্ট থেকে স্বস্তি পেলে আমরা যেন মনে না করি যে, এখন থেকে শুধু আরামেই থাকব। তাদাব্বুরে কোরআন
কোরআনে করিমের শুধু এই আয়াত নয়, এমন আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদের হতাশা, অবসাদ, অস্থিরতা ও অপ্রাপ্তির কষ্ট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। জীবনে কেন কোনো একটি কষ্ট এসেছে, তা বুঝতে সাহায্য করবে। কোরআন আমাদের আত্মার জন্য এক নিরাময়। একে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, যেন দিশেহারা মানবজাতি পথ খুঁজে পায়। এ কারণে কোরআনে করিমে আমরা অনেক আয়াত পাই, যেখানে আল্লাহ আমাদের জীবনের নানা সমস্যা মোকাবিলা করার পথ দেখিয়েছেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, জীবনটা অতিরিক্ত কষ্টের। আর সহ্য করতে পারছেন না। ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা কখনো দেন না। প্রত্যেকেই যা ভালো করেছে তার পুরস্কার পায়, যা খারাপ করেছে তার পরিণাম ভোগ করে।’ সুরা আল বাকারা : ২৮৬
অশান্তিতে ছটফট করছেন? রাতে ঘুমাতে পারছেন না? ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন? ওষুধ খেয়েও মনে শান্তি আসছে না? দেখুন কোরআন কী বলে, ‘যাদের ইমান আছে, তারা যখন আল্লাহর কথা ভাবে, জিকির করে, তখন তাদের মন শান্তি খুঁজে পায়। মনে রেখো, আল্লাহর কথা ভাবলে, জিকির করলে, অবশ্যই মন শান্তি খুঁজে পাবেই।’ সুরা আর রাদ : ২৮-২৯
‘তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা করো এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, কারণ আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা করে।’ সুরা আল বাকারা : ১৫৩
আপনার কোনো নিকটজন অকালে প্রাণ হারালেন আর আপনি ভাবছেন হায়, যদি সে এটা করত, এটা না করত, তাহলে সে বেঁচে যেত? কখনো না। দেশে অরাজকতা, অশান্তি, অপরাধ দেখে সবসময় অকালে মৃত্যুর ভয়ে কাবু হয়ে আছেন? ভাবছেন বিদেশে চলে যাবেন? ‘তুমি যেখানেই যাও না কেন, মৃত্যু তোমাকে ধরবেই। তুমি যদি অনেক উঁচু দালান বানিয়েও থাকো।’ সুরা আন নিসা : ৭৮
অমুকের এত বাড়ি-গাড়ি-টাকা দেখে ভাবছেন, কেন তার মতো এমন নামে মুসলিমের জীবন এত আরামের? চাকরি হারিয়ে আপনার মাথায় হাত, কেন আপনার সঙ্গে এমনটা হলো? কেন আপনার সন্তান এত গুরুতর অসুস্থ হলো? কেন আপনার বাবা এই দুঃসময়ে মারা গেলেন? ‘আমি তোমাদের ভয়, ক্ষুধা, সম্পত্তি, জীবন এবং ফসল হারানো দিয়ে পরীক্ষা করবই। জীবনে কোনো বিপদ আসলে যারা ধৈর্যের সঙ্গে চেষ্টা করে এবং বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই সম্পত্তি। আল্লাহরই কাছে আমরা শেষ পর্যন্ত ফিরে যাবে’ তাদের সুসংবাদ দাও! ওদের ওপর তাদের প্রভুর কাছ থেকে আছে বিশেষ অনুগ্রহ এবং শান্তি। এ ধরনের মানুষরাই সঠিক পথে আছে।’ সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭
কোরআনে করিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো, তোমার যা ধনসম্পদ আছে এবং তোমার সন্তানরা, এগুলো শুধুই তোমার জন্য পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। আর মনে রেখো, আল্লাহর কাছে রয়েছে অপরিসীম পুরস্কার।’ সুরা আল আনফাল : ২৮
‘তারা কী লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতিবছর তাদের ওপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবা করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না।’ সুরা আত তওবা : ১২৬
তাই আসুন, কোরআনে করিমের আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। আল্লাহ আমাদের কোরআন দিয়েছেন আত্মিক নিরাময় হিসেবে। মানুষের যাবতীয় মানসিক সমস্যার সমাধান রয়েছে কোরআনে। নিয়মিত বুঝে কোরআন পড়লে আমরা খুব সহজেই ওষুধের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারব, স্ট্রেস-ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
‘তাই যখনই কোনো কাজ থেকে অবসর পাও, তখনই নিবেদিত হও, তোমার প্রভুকে পাওয়ার জন্য তার দিকে ফিরে যাও।’ এই আয়াতটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম কোনো পার্টটাইম প্রজেক্ট নয় যে, বাকি সব কাজ শেষ হলে যদি সময় পাওয়া যায় তো একা কিছু ধর্ম-কর্ম করব, না হলে কী আর করা? পড়ালেখা, চাকরি, পরিবারের দেখাশোনা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, আর্টিকেল লেখা, ফেইসবুকে ধর্মের কথা বলা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সমস্যার সমাধান করা এত সব দায়িত্বের পর একা ধর্ম-কর্ম করার সময় কোথায়?
বরং মহান আল্লাহ বলছেন, যখন কাজের ফাঁকে সময় পাবে, তখনই যেন আমরা আল্লাহর প্রতি আরও নিবেদিত হই। শুধুই আল্লাহর প্রতি একান্ত ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলি। এই একান্ত ইবাদত খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কল্যাণের মাধ্যম।
মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত ইবাদতে সময় দেওয়া বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দুঃখজনকভাবে আজকে অনেক মুসলিমেরই ব্যক্তিগত ইবাদত হয়ে গেছে সংক্ষিপ্ত, লোকদেখানো কিংবা খুবই নিচু মানের। পরিবার, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব থেকে নিজেকে আলাদা করে, প্রভুর সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য কোনো চেষ্টা নেই। বরং এসবের মধ্যেই ডুবে থেকে কোনোমতে ন্যূনতম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারলেই যেন পার পেয়ে যাই। কোনোভাবে না খেয়ে দিন পার করতে পারলেই ভাবি- যাক রোজা হয়ে গেছে। কিছু লুঙ্গি-শাড়ি বিতরণ করেই ভাবি, জাকাতের পার্ট শেষ। আর মক্কা-মদিনা গিয়ে কিছু আচার-আচরণ পালন শেষে ভাবি, হজটাও আদায় হয়ে গেছে।
যশ-খ্যাতির কথা না ভেবে, একটু ঘুম ত্যাগ করে, আরাম-আয়েশ কমিয়ে, সেই সময়টা একান্তভাবে আল্লাহর প্রতি নিজেকে নিবেদিত করে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই একান্ত ব্যক্তিগত ইবাদতই পারে একজন বান্দাকে আল্লাহর আরও কাছে নিয়ে যেতে। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে। কিন্তু যারা নীরবে-নিভৃতে ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগি করে না, তাদের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক হয় এক ধরনের দায়সারা। ইসলাম মানতে হবে, তাই মানে। কিন্তু এভাবে মেনে তারা কোনো শান্তি, তৃপ্তি পায় না। হাজারো প্রশ্ন এবং অভিযোগ নিয়ে জীবনটা পার করে, এক সময় অশান্ত, অতৃপ্ত আত্মা হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যায় (মৃত্যুবরণ করে)। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
ভয়েস/আআ